রাষ্ট্রপতিকে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের চিঠি

 প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০২:৫০ পূর্বাহ্ন   |   জাতীয়


আলোচিত বার্তা ডেস্কঃ

প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে আবারও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়েছেন দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের পক্ষে চিঠিতে সই করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক।

রোববার এ তথ্য জানানো হয়। এর আগেও এই বিশিষ্ট নাগরিকরা চিঠি দিয়েছিলেন। এবারের চিঠিতে কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে অতিরিক্ত কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন তারা। এসব তথ্য বিভিন্ন সময়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

গত ১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির কাছে দ্বিতীয় দফায় চিঠি পাঠানো হয়। এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় চিঠিতে নির্বাচন-সংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। এতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ইসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তারা।

প্রথম চিঠিতে বলা হয়, ‘এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি, রেকর্ড ও দলিল, প্রদেয় অর্থ ও অর্থ গ্রহণসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সকল লিখিত প্রমাণাদি নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তলব করতে পারে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একমাত্র সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।’

ওই চিঠি পাঠানোর প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইসিকে দায়ী করে বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্য দেওয়া অনভিপ্রেত ও আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

এবার রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য প্রথম আবেদনের সংযুক্তি হিসেবে এই চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ-সম্পর্কিত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বেসরকারি চ্যানেল বৈশাখীর সাত পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কপিও সংযোজন করা হয়। আরও সংযোজন করা হয়, একই বিষয়ে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) দপ্তরের উত্থাপিত অডিট আপত্তি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের কপি।

প্রথম চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের (৪২ নাগরিকের) অভিযোগের বিষয়ে সামনাসামনিভাবে অবগত করার জন্য আপনার (রাষ্ট্রপতির) সুবিধামতো সময়ে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছি।’ দ্বিতীয় চিঠিতে বলা হয়, দীর্ঘ নয় মাসের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ ইলেক্টোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ভয়াবহ দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম সম্পর্কে ২০১৯ সালে বৈশাখী টেলিভিশনে সাত পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। প্রতিবেদনে বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স পরিচালক, কোর্স সমন্বয়ক, সহকারী সমন্বয়কসহ ‘বিতর্কিত’ ১৫টি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্য চারজন কমিশনার, সচিব, ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকসহ কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে অন্যায় ও অনৈতিক আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ সালে অল্প কিছু কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ বাজেট থেকে ১১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এরমধ্যে অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকা নিয়েছেন সিইসিসহ ও অন্য চার কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের সচিব, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রধানসহ মাত্র ১৮ জন কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে প্রকাশিত বক্তব্যে কমিশনের বর্তমান সচিবও এমন অর্থ ভাগাভাগি করে নেওয়ার নীতিগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষে পাঠানো চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ্‌দীন মালিক বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে এটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। কমিশনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এটিকে স্বেচ্ছাচারিতামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে নয় কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের ট্যাপের টাকা অভিনব কৌশলে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য নয়; বরং নিরপেক্ষভাবে জনকল্যাণে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার জন্য।

চিঠিতে আরও বলা হয়, কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের ট্যাপের কোটি কোটি টাকা প্রশিক্ষণের নামে ভাগাভাগি করে নেওয়া দুর্নীতিমূলক চরম গর্হিত কাজ, যা সম্পর্কে অডিট আপত্তি উঠেছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আর একই কাজের জন্য দুইবার সুযোগ-সুবিধা নেওয়া আইনের ভাষায় ‘ডাবল ডিপিং’, যা অন্যায়, অনৈতিক ও গুরুতর অর্থসংশ্নিষ্ট অসদাচরণ।

চিঠিতে বলা হয়, বৈশাখী টেলিভিশনে প্রচারিত ও ইউটিউবে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিংক ও সিডি এ আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি এবং এ-সম্পর্কিত অডিট আপত্তি নিয়ে গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়ের লিংক ও কপি সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব ডকুমেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, কেবল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যথাযথ তদন্তে ৪২ নাগরিকের অভিযোগগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হতে পারে। চিঠিটি বাহকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে সরাসরি পাঠানো হয়েছে বলে জানান শাহ্‌দীন মালিক। তিনি বলেন, কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। এটা করতে পারে একমাত্র সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অথবা দুদক।

চিঠিতে সই করা ৪২ নাগরিকের মধ্যে রয়েছেন, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক এম হাফিজউদ্দিন খান, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী।

চিঠিতে আরও সই করেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শাহ্‌দীন মালিক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর ও সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল।

আরও সই করেছেন স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, অধ্যাপক সি আর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম।

চিঠিতে সই করেছেন সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

জাতীয় এর আরও খবর: