জামায়াতে ইসলামী কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে লক্ষ্যে হিন্দু প্রার্থীকে মনোনয়ন
মো: ইকবাল হোসেন: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ (বটিয়াঘাটা-দাকোপ) আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়ন পেয়েছেন ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি কৃষ্ণ নন্দী। কৃষ্ণ নন্দীকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমীর ডা. শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। জামায়াতে ইসলামী থেকে অন্য ধর্মের প্রার্থী ঘোষণায় সারাদেশে একটি মহল নেতিবাচক সমালোচনা শুরু করেছে।
এসকল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা অজ্ঞতার বশে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রয়েছে ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যে জনহিতকর রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং রাসূল (সা.) জীবন দর্শনকে অজানা।
অনেকে নানা সমালোচনা করে প্রশ্ন তুলছেন, "একজন হিন্দু কীভাবে ইসলামের দাওয়াত দেবেন?" অথচ ইসলামী ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মুসলিম শাসনামলে অমুসলিমদের প্রশাসনিক ও স্থানীয় নেতৃত্বে বহাল রাখা একটি স্বীকৃত নজির।
ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় 'মুয়াহিদ' বা 'প্রটেক্টেড রুলার'। যারা মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলের শাসনভার পরিচালনা করতেন। তেমনই জামায়াতে ইসলামীর একটি সম্ভাব্য সংসদীয় আসন খুলনা-১ (বটিয়াঘাটা-দাকোপ)।
মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় মুসলিম ও অমুসলিমদের নিয়ে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে সৌদি আরবে একটি বহু জাতির আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তিনি একটি মানবিক, সামাজিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন। এতে জনগণের নাগরিক, ধর্মীয় অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত সহ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে মদিনায় শান্তি, শৃঙ্খলা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর এ মদিনা সনদ বিশ্ববাসীকে পরবর্তী প্রজন্ম ও ভবিষ্যতে একটি কল্যাণকর ও জনহিতকর রাষ্ট্র পরিচালনায় জাতীয় ঐক্যের মূলনীতিতে পৌঁছানোর অনুপ্রেরণা দেয়। বর্তমানে ইসলামি রাষ্ট্রনীতি ও আধুনিক সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এ মদিনা সনদ।
নবীজী (সা.)-এর যুগে নাজরান অঞ্চলের খ্রিষ্টান নেতারা নবীজী (সা.)-এর সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের ধর্মীয় ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। বাহরাইনের গভর্নর আল-মুনযির ইসলাম গ্রহণের আগেও অমুসলিম হিসেবেই রাসুল (সা.) কর্তৃক স্বপদে বহাল ছিলেন।
খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে খলিফা উমর (রা.) জেরুজালেম বিজয়ের পর সেখানকার খ্রিষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াসকে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের দায়িত্বে রাখেন। একইভাবে মিশর বিজয়ের পর কপটিক খ্রিষ্টানদের প্রশাসনিক দায়িত্বে রাখা হয়।
পরবর্তী শাসনামলে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে সিন্ধুর হিন্দু প্রধানরা এবং স্পেনের খ্রিষ্টান কাউন্টরা মুসলিম আমীরদের অধীনে থেকেও স্থানীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় অমুসলিমদের নাগরিক অধিকার এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসনিক পদায়ন কোনো নতুন বিষয় নয়। অথচ আজ যারা এই মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের অনেককেই দেখা যায় আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর অবমাননার সময় নিশ্চুপ থাকতে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে অবমাননাকারীদের পক্ষ নিতে।
ইসলামী রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ইতিহাস ভুলে যাওয়া বা ভুল ব্যাখ্যা করা কাম্য নয়। নেতিবাচক সমালোচনা না করে ইসলামের উদারতা ও সঠিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বহু-ধর্মের, বহু-সংস্কৃতির দেশ। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো ইনসাফের মাধ্যমে ন্যায়, সাম্য, নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিক একসঙ্গে কাজ করলে রাষ্ট্র হয় অধিক শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী।
লেখক- মো: ইকবাল হোসেন, শিক্ষক ও সাংবাদিক
সাবেক শিক্ষার্থী: বাংলা বিভাগ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
