বাঘায় মীরগঞ্জের রেশম চাষ কমে যাওয়ার কারণ

 প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারী ২০২৩, ০৫:৩৪ অপরাহ্ন   |   সারাদেশ




মোস্তাফিজুর রহমান , বাঘা (রাজশাহী):

রাজশাহীর বাঘায় মীরগঞ্জে এক সময় ব্যপক ভাবে রেশম চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে তা অনেক কম। সাথে চাষিরাও অনিহা প্রকাশ করছে, এর কারণ কি? 


মীরগঞ্জে বীজাগারের উৎপাদন দিন দিন কমে যাওয়ায় শ্রমিকরা বেকায়দায় পড়েছে। ৮-১০ বছর আগেও ব্যাপকভাবে রেশম চাষ হতো। বর্তমানে রেশম চাষ কমে গেছে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থান কমেছে। তাই তালিকাভূক্ত শ্রমিকরা সারা মাস কাজ পাচ্ছেনা। মাসে ১৫ দিন কাজ করে ৪৫০ টাকা হাজিরা হিসাবে মুজুরি নিতে হচ্ছে।


জানা গেছে, ১৮৬০ সালে ইংরেজদের উপজেলার মীরগঞ্জে নীলচাষের জন্য আগমন ঘটে। এই গ্রামে তারা গড়ে তোলে নীলকুঠি। আর আজও সেই নীল চাষের স্বাক্ষ্য বহন করছে উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী মীরগঞ্জ গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে শ্রমিকগোষ্ঠী ও কুঠির ধ্বংসাবশেষ নীল কুঠি।


তবে শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের পতন ঘটেছে অনেক আগে। তাদের শোষণের নানা স্মৃতি চিহ্ন আজও বহন করে চলছে মীরগঞ্জ গ্রামের মানুষ। এই গ্রামে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী আজও ভোলেনি সাধারণ মানুষ। তবে এই নীল কুটি বর্তমানে রেশম বীজাগার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।


মীরগঞ্জ গ্রামের শ্রমিক আবদুর রহমান বলেন, এক সময় এলাকার লোকজন জমিতে রেশম চারা উৎপাদন করত। বীজাগার থেকে ডিম এনে চাষ করতেন বাড়িতে। এখন তা আর হয় না। স্থানীয়রা রেশম চাষ করতে আগ্রহ হারিয়েছে। যেটুকু হচ্ছে সরকারিভাবে। হারিয়ে যাচ্ছে বীজাগারের ঐতিহ্য। তাই কাজ কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছি।


মীরগঞ্জের তোয়ায়েল হোসেন বলেন, নীল চাষের সুবিধার্থে ইংরেজরা এই অঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটায়। নীলকররা বেশিরভাগ সময় ঘোড়ায় যাতায়াত ও চলাফেরা করত। ব্যাপক কষ্টদায়ক ও নির্যাতনমূলক নীলচাষ করতে কৃষকরা একপর্যায়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। 

এক সময় এই অঞ্চলে নীল চাষের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকরা বিদ্রোহ করে। ওই সময় হাজার হাজার কৃষক ইংরেজদের নীল চাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করে। পরে নীল কমিশন গঠন করে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতে নীলকররা নির্যাতনমূলক চাষ আবারও শুরু করে।


১৮৮৯ সালে মীরগঞ্জ নীলকুঠির আশপাশের গ্রামের কৃষক একত্রিত হয়ে নীলচাষ বন্ধ করে দেয় এবং নীলকুঠি আক্রমণ করে। নীল চাষের জন্য নীলকররা এ অঞ্চলে অনেকগুলো যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে বলা হতো কনসার্ন। কনসার্নের অধীনস্থে হাজার হাজার বিঘা জমি ছিল। ন্যায্য মূল্য না দেয়া ও বাধ্যতামূলক নীল চাষ করানোর প্রতিবাদে এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময় নীল চাষ করতে স্থানীয় লোকজন অনাগ্রহ ও বিদ্রোহ করতে থাকলে নীলকররা আদিবাসীসহ ভারতের বিহার প্রদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত অধিবাসীদের এনে শ্রমিক হিসেবে নীলকুঠিতে নিয়ে আসে। এরা বুনো ও সাঁওতাল শ্রেণীভুক্ত। যেখানে নীল কুঠি ছিল সেখানেই এই বুনো ও সাঁওতাল বসতি এখনো লক্ষ্য করা যায়।

এই এলাকার পাশের গ্রামে অর্ধশতাধিক সাঁওতাল সম্প্রদায় লোকজন তখন থেকে বসবাস করে আসছে। বুনোরা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে বসবাস করলেও এদের আচার-আচরণ, হালচাল, সামাজিক কর্মপদ্ধতি, উচ্চারণ ভঙ্গি ও জীবণযাত্রার বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে এরা স্থানীয় নয়। এদের মধ্যে এক শ্রেণী মাছ ধরে জীবিকা-নির্বাহ করে। অপর শ্রেণী গাছ কাটা, মাটি কাটা ও শ্রমিকের কাজ করে। কঠিন ও পরিশ্রমী কাজ করতে এরা শারীরিকভাবে অসুবিধা বোধ করে না। এদের অনেকে সাপ নিয়ে খেলা করত। মেয়ে পুরুষ উভয়ে সমান ভাবে কাজ করতে পারে। একটি অংশ সর্দার হিসেবে পরিচিত। 

বাদুর, কাছিম, শিয়াল এদের প্রিয় খাদ্য। তবে এখন তারা বাঙ্গালী লোকদের মতো চলাফিরা ও খাওয়া দাওয়া করে। বাঙালি হিন্দুদের মতো আচার-আচরণ করলেও সামাজিক ও কর্মপদ্ধতির দিক থেকে হিন্দুর সঙ্গে এদের বেশ পার্থক্য রয়েছে। রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ঝাড়-ফোঁক, গাছের ডাল, বাকল ও শিকড় দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে। তবে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে ওই চিকিৎসা।


মীরগঞ্জ রেশম বীজাগারের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক বলেন, এ বছর বীজাগারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দেড় লাখ ডিম। যা চারটি স্কিমে উৎপাদন করা হবে। ইংরেজদের শাসনামলে যে নীল চাষ করা হয়েছিল, সেই নীলগাছের নমুনা হিসাবে কয়েকটি গাছ রাখা হয়েছে। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের সন্তানরা দেখতে আসে। স্থানীয়দের সহায়তা পেলে আগের মতো রেশম চাষের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। ভবনগুলো কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে, ইংরেজদের সেই নীল চাষ আর নীলকুঠি। তবে ১০০ বিঘা জমির উপর বর্তমানে রেশম বীজাগার স্থাপন করা হয়েছে।

 

মোস্তাফিজুর রহমান 

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি 

০১৭৮১০৫৭১৬১

সারাদেশ এর আরও খবর: