উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত খাগড়াছড়ির গুইমারা: স্বাস্থ্য-শিক্ষায় অন্ধকার, জনজীবনে দুর্ভোগ

মোঃ মুবিনুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধ:
পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলা। রামগড় উপজেলার হাফছড়ি, মহালছড়ির সিন্দুকছড়ি ও মাটিরাঙার গুইমারা ইউনিয়ন নিয়ে ২০১৪ সালে গঠিত হয় গুইমারা উপজেলা। তবে ২০২৩ সিলের ১৯ জুলাই গুইমারা উপজেলা পরিষদের ভবন নির্মাণকাজ শুরু হলেও দুই বছরে কাজের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ভবনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। কিন্তু কচ্ছপের গতিতে আগাচ্ছে উপজেলা পরিষদ ভবনের নির্মাণ কাজ। গুইমারা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে স্বল্প পরিসরে চলছে উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক কার্যক্রম। তবে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও ভূমি সেবার মতো অনেক বিভাগের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরুই হয়নি। উপজেলাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখনো মৌলিক অবকাঠামো ও সেবাখাতের উন্নয়নে অনেক পথ পিছিয়ে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘদিন যাবৎ অবহেলিত থেকে যাওয়া এ উপজেলার উন্নয়নে অতিসত্বর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্যসেবার করুণ চিত্র:
গুইমারায় এখনো পূর্ণাঙ্গ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়নি। বর্তমানে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও সেখানে নিয়মিত চিকিৎসক ও সহায়ক কর্মী না থাকায় কার্যত সেবা বন্ধ রয়েছে। এদিকে ইসলামিক মিশন সীমিত পরিসরে সেবা দিলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিজিবি কর্তৃক নির্মিত শত কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালটি সিভিলদের জন্য সীমিত আউটডোর ও ইমার্জেন্সি সেবা প্রদান করে, যা জরুরি চিকিৎসা চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিলের ছেলে প্রসবকালীন সময়ে অক্সিজেন সাপোর্ট না পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। একইভাবে, রবিবার (২০ এপ্রিল) সকালে স্থানীয় বাসিন্দা আবু তৈয়বের একমাত্র সন্তান অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করে। এসব ঘটনা গুইমারার স্বাস্থ্যসেবার করুণ চিত্র তুলে ধরেছে।
এ প্রসঙ্গে গুইমারা ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকর্মী অমৃত লাল মজুমদার বলেন, “গুইমারা উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা বলতে গেলে নেই বললেই চলে। দীর্ঘ ১০ বছরেও এখানে কোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মিত হয়নি। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিও পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জামের অভাবে কার্যত অচল। জরুরী চিকিৎসা সেবা, বিশেষ করে প্রসূতি ও নবজাতক সেবার জন্য আমাদের কোন ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় রোগীদের পার্শ্ববর্তী উপজেলায় পাঠাতে হয়, যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায় এবং রোগীর জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়। আমরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গুইমারার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ ও বিদ্যমান স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন জরুরী।”
অগ্নি নিরাপত্তার অভাব:
অগ্নি নিরাপত্তার অভাব গুইমারা উপজেলার জন্য একটি গুরুতর ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উপজেলাটি উন্নয়নশীল হলেও এখানে এখনো পর্যন্ত কোনো ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন করা হয়নি। ফলে অগ্নিকাণ্ড কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছরে বসতবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় বেশ কয়েকটি ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও দ্রুত কোনো সহায়তা না পাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। পার্শ্ববর্তী উপজেলা মাটিরাঙ্গা বা মানিকছড়ি কিংবা রামগড় থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়, যা মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় বড় বাধা।
এ অবস্থায়, একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন শুধু সময়ের দাবি নয়, বরং গুইমারা উপজেলার নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যাবশ্যকীয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
শিক্ষা খাতে উন্নয়নের প্রয়োজন:
গুইমারা সরকারি কলেজ বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করে। স্থানীয়রা কলেজটিকে স্নাতক (সাম্মান) পর্যায়ে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন, যাতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করতে পারে।
এ বিষয়ে গুইমারা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, “গুইমারা সরকারি কলেজ ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো পর্যন্ত স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী উপজেলায় যেতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের জন্য সময় ও অর্থের অপচয়। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি, গুইমারা সরকারি কলেজকে স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো জনবল সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।”
প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা:
উপজেলা অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী গুইমারায় প্রয়োজনীয় সরকারি দপ্তর ও জনবল এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। অনেক দপ্তর ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে সীমিত পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন:
গুইমারা বাজারের অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়ে বাজার ফান্ড গঠন ও আধুনিকায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিলের কাছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, আমার সন্তান অক্সিজেনের অভাবে প্রতিবন্ধী হয়েছে—এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা রাষ্ট্রীয় অবহেলার ফল। ১০ বছরেও গুইমারায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়নি, এটা আমাদের প্রতি চরম অন্যায়। প্রতিটি প্রাণের মূল্য আছে, গুইমারার মানুষের প্রাণ যেন এতটাই সস্তা? আমি স্পষ্টভাবে বলছি—আর সহ্য করবো না। আমরা স্বাস্থ্যসেবা ভিক্ষা চাই না, প্রাপ্য দাবি আদায় করবো। এখনই গুইমারায় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু না হলে আমরা সংগঠিত প্রতিবাদে যাবো।
পাশাপাশি তিনি আরো বলেন, আমার সন্তান অক্সিজেনের অভাবে প্রতিবন্ধী হয়েছে। এই ব্যথা আমি সারাজীবন বইবো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? ১০ ১০ বছরেও গুইমারায় একটা পূর্ণাঙ্গ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলো না। এটা কেবল অবহেলা নয়, এটা অপরাধ!
আর আগুন লাগলে? ফায়ার সার্ভিস তো দূরের কথা, আগুন নেভানোর বালতি পর্যন্ত নেই আমাদের উপজেলায়! একটা উপজেলার মানুষকে এমন বেহাল অবস্থায় রেখে যারা উন্নয়নের কথা বলেন, তারা মিথ্যে বলেন।
আমরা আর চুপ করে থাকবো না। আমাদের ন্যায্য দাবি—উপজেলায় এখনই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন চালু করতে হবে। গুইমারার মানুষের জীবন নিয়ে আর খেলা চলবে না!
আমি সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করছি, যাতে আমরা আমাদের এলাকার মানুষকে অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।
এ প্রসঙ্গে গুইমারা উপজেলা বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. আবুল কাশেম জানান, “গুইমারা উপজেলাটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ে ওঠেনি। জনগণের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির জন্য যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি রয়েছে, সেখানেও পর্যাপ্ত ডাক্তার ও সাপোর্টিং স্টাফের অভাবে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিজিবি হাসপাতালটি মূলত সাময়িক সদস্যদের জন্য হলেও আমরা চাই এটি সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন না থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় আমাদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গুইমারা সরকারি কলেজকে স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করা, উপজেলা অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সকল সরকারি দপ্তর পূর্ণাঙ্গ জনবলসহ চালু করা এবং গুইমারা বাজারের আধুনিকায়ন আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি, গুইমারা উপজেলার উন্নয়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।”
স্থানীয়রা গুইমারার উন্নয়নে এসব মৌলিক চাহিদা পূরণে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের উর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন