খানসামায় ঔষধ কোম্পানীর হাতে জিম্মি সাধারণ রোগী
লিটন ইসলাম
উপজেলা প্রতিনিধি
খানসামা, দিনাজপুর
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখলেই মনে হয় ঔষধ কোম্পানির কাছে জিম্মি সাধারণ রোগীরা। রিপ্রেজেনটেটিভদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা।
খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপজেলার বিভিন্ন ক্লিনিক কিংবা যে কোন ডাক্তারের চেম্বারের সামনের বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা রোগী কিংবা তার স্বজনদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) নিয়ে কৌশলে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে দেখা যায়।
খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (পাকেরহাট) ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘অনেকক্ষন অপেক্ষার পরে ভেতরে গিয়ে আমার নাতিকেকে ডাক্তার দেখালাম। বেরিয়ে আসার পরে ঔষুধ কোম্পানির তিন-চার জনের বেশি লোক প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যা, খুবই বিরক্তিকর ।
খানসামা উপজেলায় ডাক্তারদের চেম্বার গুলোতে দেখা যায়, ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি আর অন্যজন প্রেসক্রিপশন নিয়ে কৌশলে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতছে। রোগীর কাছে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে রোগীর সাথে থাকা তার ছেলে রাগানিত্ব হয়ে বলেন, ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে কি লিখেছে তা নাকি এদেরকে দেখাতে হবে, এটা কেমন কথা।
তারা নিজেদের অবস্থান কোম্পানীর কাছে তুলে ধরতে রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছেন। খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (পাকেরহাট) এর গেটের সামনে হরহামেসেই দেখা মিলবে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বর্হি-বিভাগ খোলা অথবা ডাক্তার চেম্বারে থাকা পর্যন্ত রোগী বেরিয়ে আসলে রিপ্রেজেনটেটিভকে ব্যবস্থাপত্র দেখাতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। এতে করে রোগী ও তার স্বজনরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রোগীদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাদের কোম্পানির ঔষুধ লেখা আছে কি না তা দেখতে রোগীদের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা।
আমাদের প্রতিনিধি ছবি তুলতে গেলেই ছুটে ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ আপনি কেন ছবি তুলছে? সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভূক্তভূগী তিনি জানান, তিনি গোয়ালডিহি থেকে তার অসুস্থ্য বাবাকে ভর্তি করিয়েছিলেন এখানে বাবাকে সুস্থ করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। উপর থেকে নিচে নামতে প্রায় ৭-১১০ জন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি এসে প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাদের কোম্পানির ঔষুধ লেখা আছে কি না তা দেখতে চায় অন্যজন ছবি তুলে। এরকম প্রতিদিন ঘটে। আপত্তি জানালেও কোন কাজ হয় না বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডাক্তারদের চেম্বার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের মহড়া। তারা দল বেঁধে প্রতিটি ডাক্তারের চেম্বারের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে এবং একজন একজন করে ডাক্তারের সাথে দেখা করে প্রতিটি কোম্পানির ঔষুধ স্যাম্পল দিয়ে থাকে।
ঔষুধ কোম্পানীগুলোর মধ্যে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে প্রতিদিন চলছে অসুস্থ বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা। ছোট বড় প্রায় সব কোম্পানী নিজ প্রতিষ্ঠানের ঔষুধ বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে ডাক্তারদের পিছনে স্থানীয় প্রতিনিধি লাগিয়ে রেখেছেন, রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোন কোম্পানী ঔষধ লেখেছেন ডাক্তার। ব্যবস্থাপত্র দেখানোকে কেন্দ্র করে অনেক রোগীর স্বজন ঔষধ প্রতিনিধিদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায়ও ঘটে।
একটি সূত্র জানায়, ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চাকরির পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকার ঔষুধ বিক্রি করতে বাধ্যতামূলক টার্গেট রয়েছে কোম্পানিগুলোর। এ কারণে বিক্রয় প্রতিনিধিরা চাকরি বাঁচাতে টার্গেট পূরণ করতে নানা ছলচাতুরি ও প্রলোভন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সব রকমের ঔষুধ ডাক্তার ম্যানেজ করে বিক্রি করে থাকে বলে জানা যায়।
ঔষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা টার্গেট পূরণ করতে ডাক্তার ও প্রতিষ্ঠান ভেদে কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে কলম, প্যাড, চাবির রিং থেকে শুরু করে টিভি-ফ্রিজ, আসবারপত্র সরবরাহও করে থাকে বলেও জানা যায়।
বিশ্বস্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে আরো জানা গেছে, অপ্রযোজনীয় ঔষুধ বাজারজাত করার জন্যে ঔষুধ কোম্পানির এসব রিপ্রেজেন্টেটিভ একজন ডাক্তারকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র কোম্পানির পক্ষ থেকে উপহার দিয়ে থাকেন। তাছাড়া যে ডাক্তার যে কোম্পানির অপ্রযোজনীয় ঔষুধগুলো বেশি প্রেসক্রাইব করেন, সেই ডাক্তারের জন্য মাস শেষে প্রচুর স্যাম্পল ঔষুধ এবং নগদ টাকা-পয়সা উপহার দিয়ে থাকেন। ফলে দেখা যায় চিকিৎসা ব্যবস্থা এক প্রকার জিম্মিই হয়ে আছেন ঐসব ঔষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকটি ফার্মেসীর কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ঔষুধ কোম্পানি গুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং নীতির ফলে দেশে অপ্রয়োজনীয় ঔষধের ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ঔষুধ বাজারজাতকরণ নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানে না। ফলে অসাধু ও অর্থলোভী ডাক্তার, হাতুড়ে ডাক্তার ও ফার্মাসিষ্টদের ফাঁদে পড়ে অশিক্ষিত ও দরিদ্র রোগীরা ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ সেবন করে প্রতারিত হচ্ছে ।