জনবলের অভাবে নির্মাণের ছয় বছরেও চালু হয়নি দুই হাসপাতাল
মনা,বেনাপোল (যশোর)প্রতিনিধিঃ
মা ও শিশুর জন্য যশোরের শার্শা উপজেলা ও বেনাপোল পৌরসভায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ হয়েছে। তবে নির্মাণের ছয় বছরেও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উপজেলাবাসী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের টানাপড়েনে এ বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মা ও শিশুদের সেবা নিশ্চিত করতে সরকার উন্নয়ন খাতে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৪৭টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের গোড়পাড়া বাজারে ও বেনাপোল বন্দরের তালরাশিতে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
২০১৫ সালে হাসপাতাল দুটির নির্মাণ কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। হস্তান্তরের ছয় বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যক্রম চলছে না।
স্থলবন্দর বেনাপোলে চাকরি ব্যবসাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করে বন্দরে। জরুরি কোন দুর্ঘটনায় কোন শ্রমিক আহত হলে বা কোন প্রসূতির জরুরি ডেলিভারির প্রয়োজন হলে তাকে বেনাপোল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হয়। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে যশোর সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করাতে হয়। ৩৮ কিলোমিটার যাওয়ার সময় অনেকে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ নিয়ে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে চরম ক্ষোভ। এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ছিল এবার তারা চিকিৎসা সেবা পাবেন। বিনা চিকিৎসায় আর কোনো গর্ভবতী নারীর জীবন ঝরবে না। কিন্তু স্বপ্নের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণের ছয় বছরেও চিকিৎসক নিয়োগ না হওয়ায় সেবা মেলেনি।
এদিকে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি দুটি উদ্বোধন এবং কার্যক্রম চালু হবে এমন তোড়জোড়ে পাঁচ বছর আগে দু-চারটি চেয়ার টেবিল ও রোগীদের কয়েকটি বেড আনা হয়। সেগুলো এখন নষ্ট হওয়ার পথে। এছাড়া ছয় বছর আগে নির্মিত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দরজা জানলা ও ভবন দুটির রঙসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে পড়ছে।
বেনাপোলের বাসিন্দা সংবাদকর্মী আশানুর রহমান বলেন, গত মাসে তার মেয়ে গর্ভবতী অবস্থায় তার বাড়িতে ছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হলে তাকে শার্শা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার তাকে যশোর নিতে বলেন। যশোরের ডাক্তাররা তাকে দেখেনি। পরে খুলনা নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, বাড়ির কাছেই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। কিন্তু সেটি চিকিৎসকের অভাবে চালু হয়নি। এখানে দ্রুত সেবা পেলে হয়তো মেয়েকে হারাতে হতো না।
বেনাপোল ১০ শষ্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের অফিস সহকারী রুস্তম আলী বলেন, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি চালু হলে এখানে এ জনপদের অনেক মানুষ উপকৃত হবে। তবে এটি চালু না হওয়ায় ভবনটিতে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। রাতে অচেনা মানুষ প্রাচীরের ওপর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে নেশা করে। তাদের আমরা কিছু বলতে পারি না। কারণ তারা এলাকার উঠতি বয়সের তরুণ ছেলেরা।
বেনাপোল মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখানে একটি পুরাতন জরাজীর্ণ ভবন ছিল, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাতে চিকিৎসা দিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বর্তমান সরকার মা ও শিশুদের ভালো স্বাস্থ্যসেবা দিতে এখানে ছয় বছর আগে ১০ শয্যার একটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করলেও তা এখনো উদ্বোধন করা হয়নি। সম্প্রতি কিছু আসবাবপত্র আসছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রচেষ্টায়। শুনেছি আগামী বছরের প্রথম দিকে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
অন্যদিকে নিজামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, আমার ইউনিয়নে ২৮ হাজার ১৮৯ জন মানুষের বসবাস। কিন্তু গোড়পাড়া বাজারে স্থাপিত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় ছয় বছর যাবত সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নিজামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার নিতু বলেন, করোনার সময় আমার এক আত্মীয় গর্ভাবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিধিনিষেধের কারণে যানবাহন চলছিল না। মোটরসাইকেলে বসিয়ে যশোর নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, এতদিনেও মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র দুটি চালু না হওয়ায় মায়েরাও সেবা বঞ্চিত। গুরুতর অসুস্থরা দূর-দূরান্তে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পথে রাস্তায় জীবন দিচ্ছে। চিকিৎসা কেন্দ্র দুটি চালু করতে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা আশাবাদী।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর আলিফ রেজা বলেন, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র দুটি চালু হওয়া জরুরি। বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দেখছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করা হয়েছে।
শার্শা উপজেলা মা, শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মেডিকেল কর্মকর্তা আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, উপজেলায় দুটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আপাতত পাঁচটি করে বেড ও চেয়ার টেবিল সরবরাহ করা হয়েছে। চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বরাদ্দ হয়নি। সরকারের পরিকল্পনা ছিল একসঙ্গে সবগুলো সেবাকেন্দ্র চালু করার। কিন্তু পদ অনুমোদন ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে এতদিন নিয়োগ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২০ সালে জানুয়ারিতে আবেদন গ্রহণ শেষ হয়। প্রত্যেক মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে দুজন চিকিৎসক, দুজন নার্সসহ মোট ১৮ জন জনবল থাকবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আশা করা যাচ্ছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু হবে।
জনবল না থাকায় হাসপাতালটি চালু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর হাসপাতালটি নির্মাণের পর স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জনবল সঙ্কটের কারণে তারা কার্যক্রম চালু করতে পারেনি।