১৭ মে ১৯৮১, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক- টার্নিং পয়েন্ট।

 প্রকাশ: ১৬ মে ২০২১, ০২:৪৮ অপরাহ্ন   |   রাজনীতি



যে কোনো স্বাধীন ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সবসময় সমানতালে চলেনা, চলতে ও পারে না। ইতিহাসে কখনও কখনও ছন্দপতন ঘটে, রচিত হয় কলংকিত অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ও এমন অধ্যায় রচিত হয়েছে। কোনো কোনো ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাস আবার সঠিক পথে টার্ন করে, যে ঘটনা গুলোকে আমরা বলে থাকি টার্নিং পয়েন্ট বা ইতিহাস বদলে  দেয়া সময়। 

১৯৮১ সালের ১৭ মে, রবিবার দিনটিও বাংলাদেশের ইতিহাসের এমনই এক টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের মাধ্যমে সাড়ে ৭ কোটি বাংগালী যেমন চুড়ান্ত ভাবে ২৩ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্ত হবার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলো এবং ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ কে স্বাধীন করতে পেরেছিল, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতা প্রাপ্তি যেমন পূর্ণতা পেয়েছিল ; ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসনে থাকার পর সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা  উপেক্ষা করে  বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন ও বাংলাদেশের ইতিহাসের এমনই এক স্বপ্ন পূরনের স্বপ্ন দেখার দিন। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট  দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে নরঘাতকরা ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলংকিত অধ্যায় রচনা করে।  এ হত্যা কান্ডের পর ষড়যন্ত্র কারীদের ক্রীড়ানক শাসক হিসেবে ক্ষমতায়  বসেন খন্দকার মোশতাক ; ঠিক যেন পলাশীর যুদ্ধের পরে নবাব সিরাজকে হত্যা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রীড়নক শাসক নতুন এক মীরজাফর!  শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুন্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র। ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করা হয়, কারান্তরীন থাকা অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে  কারাগারের নিরাপদ কক্ষে হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। 

মীরজাফরের শাসন যেমন ক্ষণস্থায়ী ছিলো, তেমনই ভাবে বাংলার নতুন মীরজাফর ও ক্ষমতায় স্থায়ী হতে পারননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একসময়  অন্তরালের ষড়যন্ত্র কারীরা সরাসরি ক্ষমতা হস্তগত করেন। ক্ষমতায় আসেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। শুরু হয় রাজাকার আলবদরদের  ক্ষমা, আশ্রয়, প্রশ্রয় এমনকি ক্ষমতায়ন।হৃষ্টপুষ্ট হতে থাকে স্বাধীনতা বিরোধীরা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটককৃত হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করা হয়, রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয় আর এক রাজাকারকে, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজাকারদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়, ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে চিরতরে রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ কারীদের পুরস্কার হিসেবে বিভিন্ন দূতাবাসে উচ্চ পদে নিয়োগ দেয়া হয়।  ত্রিশ লক্ষ  শহীদ পরিবার, সম্ভ্রম হারানো দুই লক্ষ মা-বোন, ভাগ্যক্রমে বেচে থাকা অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অসহায়ের মতো দেখতে থাকেন স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন।বাংলাদেশের ইতিহাস যেন  চলতে থাকে উল্টো পথে ।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অসহায় হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু ইতিহাস এভাবে চলতে পারেনা, বেশীদিন চলেনি। কারণ ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলেও হত্যা করতে পারেনি তার আদর্শকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দ্বিধা বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তারা বেচে থাকা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেন। আর তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা ১৯৮১ সালের  ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করেন।  স্বাধীন দেশের উল্টো পথে চলতে থাকা ইতিহাসকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করেন জাতির পিতার কন্যার হাতে। পিতার আদর্শের সৈনিকদের এমন সিদ্ধান্তকে সম্মান করে দেশের স্বার্থে নিজ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু তৎকালীন  

সামরিক জান্তা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।

অবশেষে সকল বাধা উপেক্ষা করে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দিনটি ছিল  ১৯৮১ সালের ১৭ মে, রবিবার ; ঝড়-বাদলপূর্ণ একটি দিন। শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে দুর্যোগপূর্ণ সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলো, মিছিলের শহরে পরিণত করেছিলো ঢাকা শহরকে। কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকা ও শেরে বাংলা নগর এলাকা  জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছিলো। লক্ষ লক্ষ জনতা সেদিন অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো- কখন নেত্রী আসবেন। অবশেষে বিকাল চারটায় নেত্রী এলেন। পয়ষট্টি কি.মি. গতির কাল বৈশাখী সেদিন এ জনস্রোতকে দমাতে পারেনি। তারা সেদিন শেখ হাসিনাকে সাহস যুগিয়ে বলেছিল - হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেবো। সেদিনের সেই জনসমুদ্রে আবেগাপ্লুত শেখ হাসিনা ও বলেছিলেন - সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই, আপনাদের নিয়ে আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই। এ স্বপ্ন তিনি সেদিন দেখাতে পেরেছিলেন কারণ ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- ১৫ আগষ্টের ঘাতকেরা পিতা মুজিবকে হত্যা করতে পারলে ও তার আদর্শ ও আদর্শের সৈনিকদের হত্যা করতে পারেনি। এ দিনটি ছিলো বাঙালির সাহস সঞ্চারের দিন, অনুপ্রাণিত হওয়ার দিন।

শেখ হাসিনা যেমন সব হারিয়েও পিতার আদর্শের সৈনিকদের মাঝে সব প্রাপ্তির সুখ অনুভব করেছিলেন ; তেমনি ভাবে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি খুজে পেয়েছিল তাদের ত্রান কর্তা কে। সেদিনের সেই রবিবার বাঙালি যেন শনি পেরিয়ে প্রকৃত রবি'র দেখা পেয়েছিল। 


সেই থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে  দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার পুণরুদ্ধার করতে বারবার তাকে সৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে হয়েছে, অসংখ্য বার মৃত্যুর ঝুকিতে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কোন কিছু তাকে টলাতে পারেনি, হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করে আবির্ভূত হয়েছেন "গণতন্ত্রের মানসকন্যা" রুপে।


তার নেতৃত্বে চারবার রাস্ট্র ক্ষমতার মধ্যে বর্তমানে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে  আর চারবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনসহ তিনবার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ হাসিনা।  নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে পিতার মতোই তিনি অবিচল, অটল, দৃঢ় ও সাহসী। রাস্ট্র নায়ক শেখ হাসিনা তার সততা, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা রাস্ট্র নায়কের স্বীকৃতি পেয়েছেন। চারবার রাস্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। 

জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রাজনীতিতে দ্বিধাবিভক্ত  নিজ দলকে ঐক্যবদ্ধ করাসহ স্বৈর শাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং  দুঃখী বাঙালির মুখে হাসি ফোটাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। জাতির পিতার খুনি ও একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতিকে শাপমুক্তি দিতে পেরেছেন। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে কোনো সূচকে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে,  বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। ইতোমধ্যে  দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করে একটি আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মান করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে  দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক দেশে উন্নীত করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বেই করোনা সংকট জয় করে  বাংলাদেশ তার কাংখিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। 

পচাত্তর পরবর্তীতে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র যেভাবে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশকে ক্ষতবিক্ষত করছিলো, পরিচালিত করছিলো উল্টো পথে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর এই দেশে ফিরে না আসলে আমরা স্বাধীনতার চেতনাহীন এক জাতিতে পরিনত হতে পারতাম, বঞ্চিত হতে পারতাম উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা থেকে। তিনি এসেছিলেন বলেই আমরা আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি, স্বপ্ন দেখছি একটি উন্নত সমৃদ্ধ এবং আধুনিক কল্যাণকর এক বাংলাদেশের।

আর তাইতো এদিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম এক- টার্নিং পয়েন্ট।। 


# জাহিদুর রহমান,

প্রচার সম্পাদক,

মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ। 

গোপালগঞ্জ।

রাজনীতি এর আরও খবর: