যশোর শার্শা উপজেলা নির্বাচনে একঘরেই তিন প্রার্থী কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ

 প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন   |   রাজনীতি




মনা,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

এগিয়ে এসেছে যশোরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা শার্শার নির্বাচন। আগামী ২১ মে এই উপজেলাতে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। তার আগেই নির্বাচন নিয়ে প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের আশংকাই যেনো সত্যি হতে চলেছে। তুমুল নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সীমান্তবর্তী এই উপজেলার পরিবেশ। ইতিমধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় সাবেক একজন ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। অন্যান্য স্থান থেকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে জোরালো হয়ে উঠেছে কে হতে যাচ্ছেন এই উপজেলার আগামী চেয়ারম্যান। এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কাউকেই এগিয়ে রাখতে নারাজ ভোটাররা। সকলেরই প্রায় এক মত-নির্বাচন হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময়। এরসাথে যুক্ত আরও কিছু বিষয়। সেগুলো সফলভাবে যে প্রার্থী বাস্তবায়ন করতে পারবেন তিনিই পরবেন বিজয়ের মালা।


দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল যশোরের শার্শা উপজেলার অন্তর্গত। এই বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে সরকার। ভারতের পশ্চিমবাংলার রাজধানী কোলকাতার দূরত্ব কম হওয়ায় দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পাসপোর্ট যাত্রী এই বন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করেন। তা থেকেও সরকারের ভান্ডারে জমা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। বৈধ এসব চ্যানেলের বাইরেও এই সীমান্ত দেশের অন্যতম চোরাচালান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। পণ্য পাচার, মানব পাচার ও মানব চোরাচালানের মতো বড় অপরাধগুলোও এই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। হয় অস্ত্র ও সোনা চোরাচালানও।


স্থানীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বেনাপোল বন্দরের উপর অনেক মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। সে কারণে এই বন্দরে যারা যুক্ত সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়ের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগাদা স্থানীয় রাজনীতিকদের মধ্যে বরাবরই দেখা যায়। আবার বেআইনি ব্যবসায়ের সাথে যুক্তদের নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে অনেক নেতা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি জারি রাখতেও সচেষ্ট হন। সে কারণে জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের যে কোনো নির্বাচনে শার্শা এবং বেনাপোল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবসময়। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও এর বাইরে নয়। তবে, এবারের নির্বাচনটি আরও একটি কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তা হলো সরকারি দল আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া। ফলে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠতেও কাউকে কাউকে উৎসাহিত করেছে। যা নির্বাচনকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ নিয়ে শংকাও তৈরি হয়েছে।

শার্শা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১১ জন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। তারা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মিন্নু (মোটরসাইকেল), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল (ঘোড়া), উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ (আনারস) এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন (দোয়াত কলম)।


ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার (তালা), সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সরদার সাহরিন আলম বাদল (টিউবওয়েল), যুবলীগ নেতা তরিকুল ইসলাম মিলন (টিয়া পাখি) এবং শফিকুল ইসলাম মন্টু (চশমা)।


মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনজন। তারা হলেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আলেয়া ফেরদৌস (হাঁস), নাজমুন নাহার (ফুটবল) এবং জেলা যুবমহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা আলম সালমা (কলস)।

২ মে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের পর পরই নির্বাচনী ময়দান কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকেরা। তাদের প্রচার মাইকে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো পরিবেশ।


আব্দুল মান্নান মিন্নু ছাড়া চেয়ারম্যান পদের অপর তিনজন প্রার্থী স্থানীয় রাজনীতিতে এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। যে কোনো কর্মসূচি থেকে এমপির ব্যক্তিগত ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে ছায়ার মতো সঙ্গ দিতেন অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, অহিদুজ্জামান অহিদ এবং সোহরাব হোসেন। ফলে, একই পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় এমপি শেখ আফিল উদ্দিন একটু অস্বস্তিতেই পড়েছেন বলে মনে করছেন তার সমর্থকেরা। যদিও, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন নিজেকে এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। সাধারণ ভোটাররাও তার প্রচারণাকে মেনে নিচ্ছেন।


সোহরাব হোসেনের ঘোষণা এবং এ বিষয়ে এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের প্রকাশ্য ঘোষণা না থাকায় চটেছেন অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল এবং অহিদুজ্জামান অহিদ। তারাও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে চলেছেন জোরকদমে। সেই সুযোগটি নিতে চাচ্ছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক আব্দুল মান্নান মিন্নু। তার পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অনেকে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যভাবে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বলেছেন, এর আগে যারা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় ভূমিকা পালন করতেন এবার তারা নিজেরাই প্রার্থী হয়েছেন। ফলে, একক কোনো প্রার্থীর পক্ষে পুরো উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না। কেন্দ্র দখল, বেছে বেছে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি, রাস্তায় ভোটারদেরকে আটকে দেওয়া, কেন্দ্রের সামনে সারিবদ্দভাবে দাঁড়িয়ে বুথের মধ্যে একজন প্রার্থীর পক্ষে দেদারছে ভোট কাটার কৌশল সম্পর্কেও সবাই সতর্ক। এই বিষয়টি মাথায় নিয়েই সকল প্রার্থীই যার যার মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছেন। সবমিলিয়ে নির্বাচনী ময়দানের লড়াইটা একপেশে আর থাকছেনা বলেই ধারণা সাধারণ ভোটারদের।

এদিকে, দিন যত ঘনিয়ে আসছে, শার্শা উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার মেঘ তত কালো হতে শুরু করেছে। বুধবার রাতে গোগা বাজারে একজন প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় নিয়ে সংঘাতে আহত হয়েছেন সাবেক একজন ইউপি চেয়ারম্যানসহ আরও কয়েকজন। এ ঘটনা নিয়ে ওই এলাকায় চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একই অবস্থা অন্য ইউনিয়নগুলোতেও। সেখানেও কর্মী-সমর্থকেরা একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। যে কোনো সময় তা বিস্ফোরিত হতে পারে বলে স্থানীয়রা আশংকা করছেন। একই আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে যশোর প্রশাসনের পক্ষ থেকেও।

গত ১২ মে রোববার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বাচন নিয়ে যে দুটো উপজেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে গোলযোগের আশংকা করা হয়েছে তারমধ্যে শার্শা অন্যমত। সভাতে এই হুশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল যে, যারা এ ধরনের অপতৎপরতা সংঘটনের স্বপ্ন দেখছে তা তাদের দিবাস্বপ্ন হয়েই থাকবে। কারণ, প্রশাসন কঠোরভাবেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে কোনো অপতৎপরতা সহ্য করা হবে না। কোনো দল, মত বা প্রার্থীকে বিশেষ কোনো সুবিধা প্রদান, কেন্দ্র দখল বা সহিংসতা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকবে জেলা প্রশাসন। যে কোনো অপতৎপরতা শক্ত হাতে রুখে দেওয়া হবে বলে সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়েছিল ওই সভায়।


উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটানিং কর্মকর্তা মোঃ কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শার্শা উপজেলা পরিষদ ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৯৯ হাজার ১১১ জন। এর ভেতর পুরুষ ভোটার এক লাখ ৫০ হাজার ১৯৯জন, নারী ভোটার এক লাখ ৪৮ হাজার ৯১০ জন ও হিজড়া দুই জন ।


শার্শা উপজেলা নিয়েই গঠিত যশোর-১ সংসদীয় আসন। এবারের উপজেলা নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১০২টি। এর ৬৬১টি বুথে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ করা হবে।

নির্বাচন উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি আনসার ভিডিপির সদস্যরাও ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন। একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে থাকবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে গঠিত ভ্রাম্যমাণ গ্রুপ।

রাজনীতি এর আরও খবর: