বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) পানাসি প্রকল্পের ফলে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা।

জাহিদ হাসান
নাটোর প্রতিনিধি
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের কৃষি জমিতে নতুন জীবন ফিরেছে। আধুনিক ভূ-উপরিস্থ সেচ প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকরা কম সময়ে বেশি জমিতে পানি ব্যবহার করে ফসল চাষে সফল হচ্ছেন। সরকারের এই উদ্যোগ শুধু ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেনি, বরং কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অধিকাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। তবে খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, লবণাক্ততা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে কৃষিজমি কমে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিসীম। এই লক্ষ্যেই সরকার পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চলনবিল এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে অনুমোদিত হয়। প্রথম তিন পর্যায়ে ৭২০টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ৩৬৯টি নলকূপ পুনর্বাসন, ৯৬৯টি নলকূপে বিদ্যুৎ সংযোগ, ২৬২টি ভূ-উপরিস্থ ও ৮৬৪টি ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ১৯০ কিমি খাল পুনঃখনন, ১০টি স্লুইসগেট ও ৫৩০টি হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার নির্মাণের মাধ্যমে ৪৫,৭০৪ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসে।
উক্ত প্রকল্পের ৪র্থ পর্যায় যা “পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প” নামে পরিচিত জুলাই ২০১৯ থেকে জুন, ২০২৪ মেয়াদে ৫৬০৫৩.২০ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ১৬/০৭/২০১৯খ্রি. তারিখে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ১৬/০৫/২০২৩খ্রি. তারিখে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকল্পের মেয়াদকাল জুলাই, ২০১৯ থেকে জুন, ২০২৫ মেয়াদে ০১(এক) বছর বৃদ্ধি করে ৬০০৫৩.০০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি রাজশাহী বিভাগের ০৩টি (পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ) জেলার ২৫টি (পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাংগুড়া, ফরিদপুর, সাথিয়া, বেড়া, সুজানগর, নাটোর সদর, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, লালপুর, সিংড়া, গুরুদাসপুর, নলডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ সদর, কামারখন্দ, কাজিপুর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, বেলকুচি, চৌহালি) উপজেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে
২৫টি উপজেলায় ৬০,৯৩০ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পেয়েছে। প্রকল্পে ৬৩০ কিমি খাল পুনঃখনন, ১,৪৫২ কিমি ভূগর্ভস্থ সেচনালা (বারিড পাইপ), ১০০ সৌরশক্তিচালিত লো লিফট পাম্প, ২৩০ ডাগওয়েল, ৫৫ কিমি আরসিসি গোপাট রাস্তা এবং ২,৪১৫টি হাইড্রোলিক ও অন্যান্য সেচ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে।
প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো জলাবদ্ধতা দূরীকরণ। ২৭,০০০ হেক্টর জমি এক ফসলি থেকে দুই বা তিন ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। সরিষা, ধান, সবজি—সব ক্ষেত্রে বাম্পার ফলন হয়েছে। খালে সঞ্চিত পানি দিয়ে কৃষকরা আমন ধান ও অন্যান্য ফসলে সম্পূরক সেচ দিচ্ছেন। পাশাপাশি মৎস্য আহরণেও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
ভূগর্ভস্থ পাইপ লাইনের ব্যবহার সেচ পানির অপচয় প্রায় ২৫% কমিয়েছে এবং জমি সাশ্রয় করেছে। সৌরশক্তি চালিত পাম্প ও ডাগওয়েল স্থাপনের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বেড়ে কৃষকের খরচও হ্রাস পেয়েছে। আরসিসি গোপাট রাস্তার কারণে ফসল সহজে পরিবহনযোগ্য হচ্ছে, অপচয় কমছে।
নাটোর রিজিয়নের ক্ষুদ্র সেচ নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, খাল পুনঃখনন, পাইপলাইন স্থাপন ও আধুনিক সেচ প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষককে কম পানি খরচ করে বেশি জমিতে সেচ দিতে সক্ষম করছে। এর ফলে উৎপাদন বেড়েছে, খরচ কমেছে, এবং জীবনমান উন্নত হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধার মাধ্যমে কৃষি কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
প্রকল্প পরিচালক, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প (পানাসি) এবিএম মাহামুদ হাসান খান বলেন, “এই প্রকল্প শুধু ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেনি, বরং কৃষক ও দেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার পথ খুলেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের প্রকল্প দেশের অন্যান্য কৃষি অঞ্চলেও বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশে দ্রুত খাদ্য উৎপাদনে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। কৃষকরা আধুনিক সেচ সুবিধা পেলে উৎপাদন আরও বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। চলনবিল এলাকায় কৃষিকে একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিচ্ছে।